• মঙ্গলবার, ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪২৯

ইতিহাস-ঐতিহ্য

একটি ছবি অজস্র কথা

  • ''
  • প্রকাশিত ১৭ এপ্রিল ২০২৪

নিজস্ব প্রতিবেদক:

ঐতিহাসিক মুজিবনগর সরকারের শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানকে দৃশ্যমান করতে গেলে ‘গার্ড অব অনার’-এর ছবিটি সবার আগে চোখের সামনে ভেসে ওঠে। মুক্তিযুদ্ধের আইকনিক আলোকচিত্র হিসেবে ছবিটি প্রায় সবার দেখা। ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ দলিল হিসেবে বহু প্রকাশনায় স্থান করে নিয়েছে এ ছবি। কিন্তু ছবিটির নেপথ্য কাহিনি এ দেশের বেশিরভাগ মানুষের এখনো অজানা। মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলার আম্রকাননে শতবর্ষী গাছগাছালির ঘন ছায়ায় রাইফেল কাঁধে নিয়ে স্থির দাঁড়িয়ে আছেন কয়েকজন পুলিশ ও আনসার সদস্য। গার্ড অব অনার পরিদর্শন করছেন শুভ্র পাঞ্জাবি-পায়জামা পরা স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের প্রথম ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম। তার পেছনে সামরিক পোশাকে মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক কর্নেল এম এ জি ওসমানী। ছবিতে অবশ্য তাকে দেখা যায় না। গার্ড অব অনারের নেতৃত্বদানকারী দলপতির পেছনে ঢাকা পড়ে গেছেন তিনি। ছবিতে অবশ্য তার মাথার বেরেটটি দেখা যাচ্ছে।

সংস্কৃতিজন আসাদুজ্জামান নূরের নেওয়া একটি সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে আমি প্রথম এই দলপতির কথা জানতে পারি। অসীম সাহসী এ মানুষটার নাম মাহবুব উদ্দিন আহমদ। জীবনকে তুচ্ছ করে মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদানের জন্য তিনি বীরবিক্রম খেতাব পান। মুক্তিযুদ্ধের আগে তিনি ছিলেন ঝিনাইদহ মহকুমার পুলিশের প্রধান [সাবডিবিশনাল পুলিশ অফিসার]। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কালরাতে বর্বর হানাদার বাহিনী বাংলাদেশের সর্বত্র গণহত্যা শুরু করলে তিনি পাকিস্তানি শাসকের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে যুদ্ধে নামেন। মার্চের ২৮ তারিখে তৎকালীন ফোর উইং ইপিআরের কমান্ডার মেজর আবু ওসমান চৌধুরী তাকে ক্যাপ্টেন মর্যাদা দিয়ে মাথায় সবুজ বেরেট পরিয়ে দেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি ৮ নম্বর সেক্টরের সাব-সেক্টর কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। মুক্তিযুদ্ধে তার অসামান্য বীরত্বগাথা শুনে আমারও রক্ত গরম হয়ে ওঠে। ঈদ আর বৈশাখের ছুটির পর গত ১৫ এপ্রিল দুপুরে আমি তার গুলশানের কার্যালয়ে যাই মুজিবনগর সরকারের গল্প শুনতে। গল্পে গল্পেই তিনি বললেন গার্ড অব অনারের বিস্তারিত কথা।

১৬ এপ্রিল কালবৈশাখী ঝড়ের রাতে তিনি ও তার শিক্ষাজীবনের সহপাঠী তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী ভারতীয় সীমান্তচৌকি বেতাই বিইউপিতে গিয়ে পৌঁছান। তৌফিক-ই-ইলাহী তখন মেহেরপুর মহকুমা প্রশাসক। ১৭ এপ্রিল খুব সকালে তৌফিক-ই-ইলাহী তাকে বললেন, ‘আজ স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সরকার [১০ এপ্রিল কলকাতায় গঠিত] মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলায় আনুষ্ঠানিকভাবে শপথ নেবে। দেশের মাটিতে সত্তরের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা শপথ নেবেন শুনে তার রক্ত চঞ্চল হয়ে ওঠে। বেতাই থেকে বৈদ্যনাথতলার দূরত্ব ১৭ থেকে ১৮ মাইল। পথে পথে ঝড়ের ঝঞ্ঝা পেরিয়ে দুই বন্ধু সকাল ১০টার মধ্যে বৈদ্যনাথতলায় এসে হাজির হন। ঝড়ের পর চারদিকে শীতল পরিবেশ। তখন মঞ্চ তৈরির প্রস্তুতি চলছে। আশপাশের বাড়ি থেকে চেয়ার, টেবিল ও পাটি আনা হচ্ছে। মঞ্চে এনে বসানো হচ্ছে হাতল চেয়ার। মঞ্চঘিরে হাজার হাজার উল্লসিত জনতা। শতবর্ষী আমগাছগুলোতে ঝুলছে শিশু-কিশোরের দল। মঞ্চের সামনে বাঁশের মাথায় বাংলাদেশের লাল, সবুজ আর হলুদ রঙের পতাকা বাঁধা। মঞ্চের একপাশে ছেলেমেয়েরা জাতীয় সংগীতের অনুশীলন করছে; তার নেতৃত্ব দিচ্ছেন শাহাবুদ্দিন সেন্টু নামের স্থানীয় এক যুবক। কিছুক্ষণ পর এসে অনুশীলনে যোগ দেন আ স ম আবদুর রব।

১১টার দিকে ভোঁস ভোঁস করে হর্ন বাজিয়ে একসঙ্গে অনেকগুলো গাড়ি এলো। এসবের মধ্যে বেশ কয়েকটি কালো গাড়ি থেকে নামলেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী, এ এইচ এম কামারুজ্জামান, খন্দকার মোশতাক আহমদ, কর্নেল এম এ জি ওসমানী, অধ্যাপক ইউসুফ আলী চৌধুরী, আবদুল মান্নান, ব্যারিস্টার আমীর-উল-ইসলাম, আমিনুল হক বাদশা, শেখ ফজলুল হক মনি, তোফায়েল আহমেদ, আবদুর রাজ্জাক, সিরাজুল আলম খান, মোস্তফা মহসীন মন্টু, ব্রজেন দাশসহ আওয়ামী লীগের নেতারা। তাদের সঙ্গে এলেন ভারতীয় ও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের বাঘা বাঘা সাংবাদিক, আলোকচিত্রী ও ক্যামেরাম্যান। একজন বিদেশি সাংবাদিক পা-পা হেঁটে জানালেন, মূল মঞ্চ থেকে ভারতীয় সীমান্তের দূরত্ব একশ গজও হবে না। আম্রকাননের চারপাশ ঘিরে সাদা পোশাকে অবস্থান নিয়ে আছে বিএসএফের জওয়ানরা।

নেতারা মঞ্চে চলে এসেছেন। শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানও শুরু হয়ে গেছে। নতুন সরকারকে গার্ড অব অনার দেওয়ার কথা মেজর আবু ওসমান চৌধুরীর। তিনি তখনো এসে উপস্থিত হননি। তার দেরির কারণে তৌফিক-ই-ইলাহী খুবই বিচলিত। তিনি দৌড়ে এসে মাহবুব উদ্দিনকে বললেন, ‘ওসমান ভাইয়ের আসার কথা ছিল। কিন্তু তিনি তো এখনো এলেন না। এখন গার্ড অব অনার দিই কী করে!’ শুনে মাহবুব উদ্দিন বললেন, ‘তুমি কোনো চিন্তা কোরো না। আমি তো পুলিশের লোক। গার্ড অব অনার দেওয়া ও নেওয়ার সঙ্গে আমার পরিচয় আছে। আমাকে পাঁচ মিনিট সময় দাও।’ মাহবুব উদ্দিনের সঙ্গে ছিলেন তার গাড়িচালক ও তিন দেহরক্ষী। আশপাশে দাঁড়িয়ে থাকা ১১ আনসার সদস্যকে একত্র করে পাঁচ মিনিটেই গার্ড অব অনারের প্রস্তুতি নিলেন। ১৬ জনের টিম। মঞ্চের সামনে সবাইকে দুই লাইনে দাঁড় করানো হলো। প্রথম লাইনে ৯ জন আর পেছনে ৬ জন। তৌফিক-ই-ইলাহীকে মাহবুব উদ্দিন বললেন, ‘আমরা এখন প্রস্তুত। তুমি বললেই গার্ড অব অনার দিতে পারব।’

শপথগ্রহণের পর সবাই মঞ্চ থেকে নেমে গেলেন। থাকলেন ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও কর্নেল ওসমানী। বেজে উঠল, ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি...।’ জাতীয় সংগীতের সঙ্গে সঙ্গে রাষ্ট্রপতি পতাকাটা ওড়াতে থাকলেন। এরপর রাষ্ট্রপতির সম্মানে সামরিক কায়দায় সমস্ত শক্তি দিয়ে প্রেজেন্ট আর্মস [অস্ত্র প্রদর্শন] করলেন সৈন্যরা। এরপর দলনেতা মাহবুব উদ্দিন কয়েক কদম এগিয়ে গিয়ে রাষ্ট্রপতিকে বললেন, ‘গার্ড ইজ রেডি ফর ইউর ইন্সপেকশন স্যার।’ রাষ্ট্রপতি ধীরপায়ে মঞ্চ থেকে নেমে এসে ঘুরে ঘুরে সোলডার আর্মস করা [কাঁধে অস্ত্র রাখা] সৈন্যদের পরিদর্শন করলেন। সে সময় অসংখ্য আলোকচিত্রীর ক্যামেরার শাটার বেজে উঠল। সবকিছু ঘটল তিন থেকে চার মিনিটের মধ্যে। পরিদর্শন শেষে রাষ্ট্রপতি গেলেন মঞ্চের দিকে। মঞ্চে উঠে স্বস্থানে দাঁড়ালেন। মাহবুব উদ্দিন এবার সালাম জানিয়ে বললেন, ‘গার্ড রেডি ফর মার্চপাস্ট স্যার।’ রাষ্ট্রপতি মার্চপাস্টের সম্মতি দিলেন। তিনি সৈন্যদের নিয়ে রাইট টার্ন কুইক মার্চ করে মঞ্চের ডান দিকে এসে দাঁড়ালেন। সৈন্যরা স্থান ত্যাগ করে জনতার সঙ্গে মিলে গেলেন। এরপর প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ মঞ্চে দাঁড়িয়ে ঘোষণা করলেন, ‘আজ থেকে স্বাধীন বাংলাদেশের রাজধানী এই বৈদ্যনাথতলা এবং এর নতুন নাম হলো মুজিবনগর।’ তার এমন ঘোষণায় দিগি¦দিক বিদীর্ণ করে ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’ সেøাগানে মুখরিত হলো চারপাশ। এর মধ্যে বিশাল ইপিআর বাহিনী নিয়ে এলেন মেজর আবু ওসমান চৌধুরী। ততক্ষণে অনুষ্ঠান প্রায় শেষ। এক ঘণ্টার মধ্যেই সব আয়োজন শেষ হয় জানালেন মাহবুব উদ্দিন। পরদিন ছবিটি ছড়িয়ে পড়ে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে। তামাম দুনিয়া জেনে যায়, বাংলাদেশের নবগঠিত সরকারের কথা।

ছবিটি দেখিয়ে মাহবুব উদ্দিন বললেন, ‘তিন সপ্তাহের ব্যবহারে ও মাটি, কাদা আর বৃষ্টির জলে সৈন্যদের খাকি পোশাকগুলো ছিল বেশ মলিন। সৈনিকদের অবস্থাও বেশ সঙিন। কারও জামা ছেঁড়া, কারও প্যান্ট। কারও বুটের ছাল উঠে গেছে। মাথায় টুপি পরা যাদের দেখছেন তারা আনসার সদস্য। আর পুলিশ সদস্যদের মাথায় বেরেট। পোশাকে মলিন হলেও এই জওয়ানদের বুকে সাহসের কমতি ছিল না।’ তবে এত দিন পর পুলিশ সদস্যদের নাম চেষ্টা করেও মনে করতে পারলেন না তিনি। নিজের টুপিটি দেখিয়ে বললেন, ‘এটা কিন্তু ইপিআরের সবুজ বেরেট, যেটা ওসমান ভাই পরিয়ে দিয়েছিলেন।’ তার কাঁধে কালো ধাতব তারা। লাল জমিনে খাকি সোল্ডার স্ট্রাপে বসানো ক্যাপ্টেনের ব্যাজ। পায়ে ছিল জলপাই রঙের জাংগল বুট।

সেদিনের অনুষ্ঠান শেষে কলকাতায় রওনা হয়েছিলেন মাহবুব উদ্দিন আর তৌফিক-ই-ইলাহী। পথে পথে যুদ্ধ করে ২০ এপ্রিল তারা কয়েকজন কলকাতার ৯ নম্বর থিয়েটার রোডে গিয়ে হাজির হন। সেদিন তারা রাত কাটান থার্ড সেক্রেটারি আনোয়ারুল করিম জয়ের বাসভবনে। পরদিন সকালবেলা তারা একসঙ্গে নাশতা সেরেছেন। তখন আনোয়ারুল করিম তার সামনে ইলাস্ট্রেটেড উইকলি অব ইন্ডিয়া সাময়িকীটি এগিয়ে দিয়ে বললেন, ‘এই দেখ মাহবুব, তোর কী বিরাট ছবি ছাপা হয়েছে!’ সাময়িকীর প্রচ্ছদ জুড়ে ছবিটির ক্যাপশনে লেখা ছিল, ‘এ ইউথফুল সোলজার গিভিং গার্ড অব অনার টু মুজিবনগর গভর্নমেন্ট।’ ছবিটা দেখে আনন্দে তার বুক ভরে ওঠে। তিনি পত্রিকাটি তার কাছে রাখলেন। ২৭ এপ্রিল সাব-সেক্টর কমান্ডার হিসেবে চলে এলেন সাতক্ষীরায়। এরপর আট মাস কেটে গেল রণক্ষেত্রে। শত্রুদের আক্রমণ আর তাদের মোকাবিলা করতে গিয়ে কোথায় যেন হারিয়ে যায় পত্রিকাটি!

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads